![]() |
‘মোহরা’ সিনেমায় বৃষ্টিভেজা গানের দৃশ্যে অক্ষয় কুমার ও রাভিনা ট্যান্ডন |
হিন্দি বা বাংলা সিনেমায় একটা-দুটো বৃষ্টির গান থাকবে এবং নায়ক-নায়িকারা সেই বৃষ্টির গানে ভিজে একশা হবেন, এটা যেন একরকম রীতি হয়ে গেছে। কিন্তু চলচ্চিত্রে কেন যুগের পর যুগ ধরে বৃষ্টিতে ভেজানো হচ্ছে নায়ক-নায়িকাদের?
হিন্দি কিংবা বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে বৃষ্টির আছে আলাদা তাৎপর্য। তবে অনেক ক্ষেত্রেই বৃষ্টি হয়ে দাঁড়ায় নায়ক-নায়িকার কাছে আসার উপলক্ষ, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘ডিভাইন ইন্টারভেনশন’ বা দৈব হস্তক্ষেপ। কিন্তু হস্তক্ষেপটা মূলত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকেরা। অঞ্জন দত্তের গানের ভাষায় বললে, একটা ‘দুষ্টু গান’ না ঢোকালে তো সিনেমা চলে না। আর এই ‘দুষ্টু গান’ ঢোকানোর একটা মোক্ষম সুযোগ তৈরি করে দেয় বৃষ্টি। ঢাকাই চলচ্চিত্রের সেই জনপ্রিয় গানটির কথা মনে করুন—‘বৃষ্টিরে বৃষ্টি আয় না জোরে/ ফিরে যাব না আজকে ঘরে...’। সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ নামের সিনেমায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নায়ক-নায়িকা যে ঘরে ফিরতে চায় না, এর পেছনে কারণ কী?
কারণ, বৃষ্টি ভেজা দুটি শরীর উষ্ণতা পেতে চাইবে, এটাই তো স্বাভাবিক!
ভারতীয় উপমহাদেশের মূলধারার চলচ্চিত্রে যৌনতা নিয়ে ঢাকঢাক-গুড়গুড় শুরু হয় সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই। এর পেছনেও রয়েছে মজার এক ইতিহাস। চলচ্চিত্র-বাণিজ্য যখন একটি শিল্প হিসেবে পরিণত হতে শুরু করে, তখন এতে স্থানীয় লোকজনের অংশগ্রহণও বাড়তে থাকে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া ভারত ও পাকিস্তানে সংস্কৃতির স্বকীয়তা সৃষ্টির প্রয়াসে পশ্চিমের সব ধরনের চর্চার প্রতি একধরনের সহজাত প্রত্যাখ্যান ছিল। ফলে তখন চুম্বন বা যৌনপ্রবৃত্তির সরাসরি প্রকাশের প্রতিও খড়্গহস্ত হয়ে ওঠে রাষ্ট্রযন্ত্র। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সমালোচক আলমগীর কবির তাঁর ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’ বইয়ে এ বিষয়ের উল্লেখ করে ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। কিন্তু গত শতকের আশির দশকের পরও সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়নি, আমাদের রুপালি পর্দায় বৃষ্টি নামছে তো নামছেই। আর ৭০ বছর ধরে নায়ক-নায়িকারা সেই বৃষ্টিতে ক্রমাগত ভিজেই চলেছেন। বিষয়টি মাথায় রেখে চলুন জেনে নেওয়া যাক, কী বলা আছে সেই সময়ের সেন্সরশিপ নীতিমালায়?
![]() |
জাগো’ সিনেমার গানের দৃশ্যে বিন্দু ও ফেরদৌস |
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নতুনভাবে সজ্জিত হলেও রুপালি পর্দায় বৃষ্টিমাখা যৌনতার প্রকাশ আগের মতোই থেকে যায়। প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ঢাকাই সিনেমার কথা তুলে ধরতে গিয়ে আলমগীর কবির বলেছেন , ‘যা-ই হোক, যৌনতা কিন্তু বাদ পড়েনি। বরং হলো উল্টোটা। বক্ষ দোলানো নাচের দৃশ্যে যৌনতা নতুন এক অশ্লীল চেহারা পেল। এখন যেমন, পা আর ঠোঁট থেকে সরে এসে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে সুডৌল বক্ষযুগল আর পুষ্ট শরীরে।’
ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণে ‘স্কপোফিলিয়া’ নামের একটি শব্দ রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক ভাষায় ‘স্কপো’ শব্দের অর্থ ‘দেখা’ ও ‘ফিলিয়া’ শব্দের অর্থ ‘প্রবণতা’। তবে এই ‘দেখার প্রবণতা’ ফ্রয়েডের বিশ্লেষণে ভিন্ন অর্থ পায়। কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে বা যৌন আচরণ দেখার মাধ্যমে যখন কেউ যৌনসুখ লাভ করে, তখন এ প্রক্রিয়াকে ফ্রয়েড বলছেন স্কপোফিলিয়া। মানুষের ব্যক্তিত্বের নির্মাণপর্বে এ প্রবণতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে শৈশবপর্বে প্রবণতাটি মননে গাঁথা থাকে বলে মনে করছেন অনেক তাত্ত্বিক। তবে এই প্রবৃত্তি বিকারেও রূপ নিতে পারে বলে সাবধান করা হয়েছে।
সিনেমার মাধ্যমে ‘দেখার সুখ’ দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন অনেক চলচ্চিত্রবেত্তা। অর্থাৎ একটি যৌন আচরণে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ না করেও দর্শক যেন সুখ লাভ করতে পারেন, এ ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থাই করা হচ্ছে। অন্ধকার হলে নিজের চেয়ারে বসে বড় পর্দায় ক্যামেরার কারসাজিতে নায়ক-নায়িকা শরীরের বিশেষ অংশ, বিশেষ অঙ্গভঙ্গি দেখানো হচ্ছে। আর সেই সুযোগ তৈরি করতে সময়-সুযোগ বুঝে নির্মাতা নামিয়ে দিচ্ছেন ঝরঝর বৃষ্টি। ফলে ভেজা শরীরে লেপ্টে যাওয়া পোশাক আর ইঙ্গিতপূর্ণ নাচে দর্শক আরও আবিষ্ট হচ্ছেন। আর এভাবেই সক্রিয় অংশগ্রহণ না করেও যৌনসুখ লাভ করছেন দর্শকেরা।
এ কারণেই কি বাংলা সিনেমার বৃষ্টিবাহিত গানে মন চনমন করে ওঠে দর্শকের!
‘এই বৃষ্টি ভেজা রাতে চলে যেও না
বৃষ্টিরও ছন্দে, বকুলেরও গন্ধে
আমায় তুমি ছেড়ে যেও না...’
হ্যাঁ, রুনা লায়লার কণ্ঠে এই আকুল আবেদন শুনে মন কেঁপে ওঠে যেকোনো দর্শকের। রুপালি পর্দায় বৃষ্টি নামে আর দর্শক নিজের আসনে বসেই শিহরিত হন। সিনেমায় যৌনতা খোলস বদলায় এবং ধরা দেয় নতুন রূপে।
0 Comments